
অন্ধকারকে তাড়াতে হলে লাঠিপেটা করে তাড়ানো যায় না, আলো দিয়ে তাড়াতে হয়। আসলে অন্ধকার বলতে কিছুই নেই, আছে আলোর অনুপস্থিতি। সমাজকে আলোকিত করতে আলোকিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। সবাই বলে শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আমি বলি শিক্ষকই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষক সমাজ একটা জাতি গঠন করতে পারেন।
কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেছেন, আমরা শিক্ষকদের বলি মানুষ গড়ার কারিগর। আমি বলি তারা হলো মানুষ গড়ার শিল্পী। কারিগর তৈরি করেদেন মাত্র। শিল্পী শৈল্পিক মন সৃষ্টি করেন। প্রাণ সঞ্চার করেন। দুনিয়াতে যাঁরা সমাজের মানুষকে পরিবর্তন করেন তাঁরা সবাই ছিলেন শিক্ষক। হযরত মোহাম্মদ (দ.),যিশু, সক্রোটিস, দাস্তে, শেক্সপিয়র, রবীন্দ্র, নজরুল, শেখ সাদী, আল্লামা ইকবাল, নিউটন, আইস্টাইন,সবাই ছিলেন মানব জাতির শিক্ষক। মহান আল্লাহ পাক প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (দ.)’র শিক্ষক আর মহানবী (দ.) মানব জাতির শিক্ষক। হাদিসে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, ‘আনা বুয়িস্তু মোয়াল্লিমান’ আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত। সব মহামনীষীরা জাতির শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকের চেয়ে সম্মানিত কেউ হতে পারে না।
আমি জীবনে ৬০/৭০ জন শিক্ষক হতে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। কয়েক শিক্ষক ছাড়া বাকিদের কথা মনে পড়ে না। যাদের মনে পড়ে না তাদের তো জোর করে মন হতে মুছে দিইনি, আর যাঁদের কথা বারবার মনে পড়ে তাদের নাম তো জপ করিনি। সেসব শিক্ষক হৃদয়ে দাগ কাটছে তাদের ভুলে যাওয়া খুব কঠিন। কারণ তাঁরা পিতা-মাতা স্বজন প্রিয়জনের মত স্নেহের পরশে কাছে টেনে ভিতরটা নির্মাণ করে নেন, তাদের ভুলা যায় না। স্বপ্নীল আবেগে তাদের কথা সারাজীবন হৃদয়ের গভীরে লালিত হবে। শাস্ত্রে আছে, পঞ্চ পিতার এক পিতা শিক্ষক। পিতা দেহ গড়েন আর শিক্ষক ভিতরে ভিতরে নির্মাণ করেন।
কেউ কাউকে শিখিয়ে দিতে পারেন না। একজন পথিক হেঁটে দিতে পারে না অন্যের পথ। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শিখিয়ে দিতে পারে না কিন্তু সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারেন।শিক্ষার রহস্যময় জগতে প্রবেশ করে জ্ঞানের কিরণে স্নান করাতে পারেন। স্বপ্ন দেখাতে পারেন।একজন প্রকৃত শিক্ষক শিক্ষার্থীকে স্বপ্ন দেখাতে পারলে বড় হওয়ার পথ শিক্ষার্থী নিজেই খুঁজে নিবে, শিখিয়ে দিতে হবে না।ড.আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘বিদ্যালয়ের শিক্ষক হলো এমন মিস্ত্রি যিনি গঠন করেন মানবাত্মা’।আত্মার পরিশুদ্ধতা না থাকলে প্রকৃতপক্ষে সে ভালো শিক্ষক নয়। শিক্ষকের মনে আগুন না থাকলে শিক্ষার্থীদের মনে আগুন জ্বালাবে কীভাবে।
আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্ক বলেছেন, A good teacher is like a candle it consumes itself to light the way for others’ অর্থাৎ একজন ভালো শিক্ষক মোমবাতির মত, যিনি
পরের পথ আলোকিত করতে গিয়ে নিজকে নিঃশেষ করে দেন। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি। জীবনে অনেকেই কবিতা লেখতে চেষ্টা করেন, কিন্তু সবাই কবি হয় না, কেউ কেউ কবি হন। দেশে প্রচুর শিক্ষক আছে সবাই শিক্ষক নন, কেউ কেউ শিক্ষক। একজন ভালো শিক্ষক হলো সে-ই যিনি সারাজীবন ছাত্র,ভালো শিক্ষকের সারাজীবন পড়াশোনা করতে হয়। ১৯৮৭ সালে মোট ৯৫২ জন শিক্ষকের মধ্যে ২৮৮ জনের লাইব্রেরী কার্ড ছিল। যাদের ছিল না তারা শিক্ষক রাজনীতিসহ নানা অন্যায় কাজে জড়িয়ে থাকতো। বর্তমান খুঁজ নিলে দেখতে পারেন ৫ ভাগ শিক্ষকের লাইব্রেরী কার্ড নেই।এই হলো আমাদের গবেষণার অবস্থা। অনেকে বলেন, বর্তমান যুগে ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষকদের সম্মান করে না,
কথাটা পুরোপুরি সঠিক নয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ দিচ্ছে সে পরিমাণ সম্মান পাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মেনে নেওয়া, আর মনে নেওয়া এক নয়। শিক্ষকের কথা আর চাকরিতে বসের কথা ভুল হলেও মেনে নিতে হয় কিন্তু মন গ্রহণ করে না। মনকে জোর করে মানতে বাধ্য করা যায় না। যেসব শিক্ষকের শিক্ষা মন গ্রহণ করে তাঁদেরকে শিক্ষর্থীরা মন হতে সম্মান করে।
আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেড বলেছেন, ‘জন্মের জন্য আমি পিতার নিকট ঋণী আর জ্ঞান ও উন্নত জীবনের জন্য আমার শিক্ষক এরিস্টটলের নিকট ঋণী। একজন ভালো শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় আলেকজান্ডারের জন্ম হতে পারে। জন্ম হতে আরে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী আবদুল কালামের মত খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। আবদুল কালাম ঢাকায় এসে জানিয়ে ছিলেন, ‘আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার শিক্ষক শিব সুব্রমনিয়াম আয়ান একদিন একটি পাখির ছবি এঁকে শিখালেন, পাখি কীভাবে উড়ে। তারপর শিক্ষক বললেন, কালাম পাখির মত কখনো উড়তে পারবে? সে হতে আমার আকাশে উড়ার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন হতে আমি আজ এখানে।তিনি আকাশে উড়েছেন, মিসাইল উড়িয়েছেন, হাজার হাজার তরুণদের মহাকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। শিক্ষক ছাত্রের প্রতি সদয় হলে জন্মদিতে পারে আবদুল কালামের মত ব্যক্তিত্ব। তাই আমেরিকার সেরা প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন শিক্ষকদের ছাত্রদের প্রতি সোহাগ নয়, সদয় হতে বলেছেন। দেশের প্রচুর শিক্ষক শিক্ষাকে আনন্দের বিষয় হিসেবে গড়ে তুলতে পারে না। যদিও শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে শিক্ষকগণ। শিক্ষকদের জীবনে আনন্দ না থাকলে তারা আনন্দ বিতরণ করবে কীভাবে ? তিনি হচ্ছেন ভালো সেনাপতি যিনি কম রক্তপাতে যুদ্ধে জয়ী হতে পারেন। আর তিনি হচ্ছে যোগ্য শিক্ষক যিনি শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠকে সরস ও জীবন্ত করার মাধ্যমে পাঠে উদ্দীপ্ত করতে পারেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো শিক্ষক। ছাত্র অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা গ্রহণ করে, আর শিক্ষক জীবিকার প্রয়োজনে প্রদান করেন জ্ঞান । কিন্তু জ্ঞানদানের সময় ছাত্র শিক্ষক কারো মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে না আর্থিক বিষয়টি। অর্থের সম্পর্ক ছাত্র শিক্ষকের মাঝখানে মধুর সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে না। দুনিয়ার মধ্যে কোথাও পরাজয়ে আনন্দ নেই। দুটি জায়গায় পরাজয়ে আনন্দ। সন্তানের নিকট মা-বাবার পরাজয়, আর ছাত্রের নিকট শিক্ষকের পরাজয়ে আনন্দ থাকে। মা বাবা হতে সন্তান যখন বড় হয় তখন মা বাবা যে রূপ আনন্দিত হন তদ্রুপ একজন শিক্ষক হতে ছাত্র যখন বড় হয় তখন শিক্ষক আনন্দে আত্মহারা হন। এই হলো ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক।
শিক্ষকরা জ্ঞান বিতরণ করে জীবন নির্বাহ করবেন এতে অপরাধের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করবে তা অন্যায়। সাবেক সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন দরিদ্র, তাঁরা আমাদের ধনী করে গেছেন। এখন শিক্ষকরা ধনী, শিক্ষার্থীরা গরিব হচ্ছে। কারণ এখন শিক্ষা বাণিজ্য চলছে’।
শিক্ষা বাণিজ্যে বিষয় হতে পারে না, কারণ দুনিয়ার মানুষকে যত সেরা কিছু দান করো না কেন, জ্ঞান দানের চেয়ে বড় কোন দান নেই। যিনি সারাজীবন জ্ঞান দান করেন তাঁর নাম শিক্ষক। শিক্ষা নিয়ে আমি ব্যবসা চাই না, কিন্তু শিক্ষার মানসম্মত উন্নয়ন চাই। টেকসই উন্নয়নের জন্য মান সম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই।
মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। শিক্ষকই প্রকৃত উন্নয়নের প্রকৃত শিল্পী। শিক্ষকের উন্নতি না হলে কোন জাতির উন্নতি হতে পারে না। তাই, দার্শনিক বার্টন্ড রাসেল বলেছেন, ‘টিচার্স আর দি গার্ডিয়ান অব সিভিলাইজেশন’ অর্থাৎ শিক্ষক সভ্যতার অভিভাবক।
প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘শিক্ষক ছাত্রকে শিক্ষার পথ দেখিয়ে দিতে পারেন, তার কৌতুহল উদ্রেক করতে পারেন, তার বুদ্ধিবৃত্তিকে জাগ্রত করতে পারেন, মনোরাজ্যের ঐশ্বর্যের সন্ধান দিতে পারেন, এর বেশি আর কিছু পারেন না। যিনি যথার্থ গুরু তিনি শিষ্যের আত্মাকে উদ্বোধিত করেন এবং তার অন্তর্নিহিত সকল প্রচ্ছন্ন শক্তিকে ব্যক্ত করে তোলেই’। এই হলো একজন প্রকৃত শিক্ষকের কাজ।
লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিক