স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল চট্টগ্রামের গর্ব। এটি চালুর মধ্য দিয়ে এপার-ওপার দুই প্রান্তের যুগান্তকারী নানা পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। বদলে যাচ্ছে আনোয়ারার,কর্ণফুলী তথা চট্টগ্রামের দৃশ্যপট। বন্দর নগরীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার এ উন্নয়নের সঙ্গে শিল্প-বাণিজ্য ও পর্যটনের প্রসারের সম্ভাবনা প্রসারিত হচ্ছে।
মানুষের যাতায়াতের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়েছে। দূর হয়েছে বহুদিনের ভোগান্তি। টানেল ঘিরেই ভাগ্যের দুয়ার খুলে গেছে। একটা টানেল ঘিরে এত বড় প্রভাব পড়তে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। আনোয়ারা প্রান্তে যানবাহনের চাহিদাও বাড়ছে।
মহা ধুমধামে দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রথম বঙ্গবন্ধু টানেল ২৮ অক্টোবর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানেলের একপাশে ব্যস্ত বন্দর, অন্যপাশে ভারী শিল্প-কারখানা। কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ের দুই দৃশ্যের মিলন ঘটছে অবশেষে, ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে চট্টগ্রামবাসী। শুধু চট্টগ্রাম আনোয়ারাবাসী নয়, স্বয়ং কর্ণফুলীর বুক চিরে স্বপ্নের টানেল নির্মাণ হওয়ায় কর্ণফুলী নদীও গর্বিত।
চট্টগ্রাম বন্দর নগরীকে চীনের সাংহাই এর আদলে গড়ে তোলার যে উচ্চভিলাসী লক্ষ্য সরকারের ছিল, তার একটি বড় পদক্ষেপের বাস্তবায়ন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ টানেলের মাধ্যমে শিল্পঘেরা কর্ণফুলীর দুই পাড়ের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হচ্ছে, সংযোগ হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের। তাতে গতি পাবে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য।
এই টানেলের মাধ্যমে নদীর দুই পাড় যুক্ত হয়েছে পথ খুলছে বিশ্বমানের যোগাযোগের। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এই টানেল উদ্বোধন উপলক্ষে এক বাণীতে বলেছেন, এই টানেলের ফলে চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে ব্লু-ইকোনমির নতুন দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর নিচে প্রথম সড়ক টানেল। দেশপ্রেমিক জনগণের আস্থা ও অকুণ্ঠ সমর্থনের ফলেই আজকে উন্নয়নের এ নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে।
চট্টগ্রামের সন্তান জিসান ও জয়নাল বলেন, আগে বিমানবন্দর যেতে সময় লাগত দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। পুরো শহরের জ্যাম ঠেলে যেতে কখনো কখনো আরো বেশি সময় লাগত। এখন সময় লাগবে ১৫ মিনিট। আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দিলে তখন আগ্রাবাদ যেতেও বেশি সময় লাগবে না।
আনোয়ারার গণমাধ্যমকর্মী নূরুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে আগে দুই উপায়ে নগরীতে যাওয়া যেত। সিইউএফএল সংলগ্ন ১৫ নম্বর জেটি ঘাট দিয়ে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে, অথবা কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু পার হয়ে।
ইঞ্জিন নৌকায় নদী পার হয়ে আনোয়ারার মানুষ ১৫ নম্বর জেটি ঘাট এলাকায় নামত। কাছেই চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। তবে নৌপথে পারাপার ঝুঁকিপূর্ণ এবং গাড়ি থেকে মালামাল নিয়ে নৌযানে ওঠানামাও কষ্ট কর।
আর আনোয়ারা সদর থেকে শাহ আমানত সেতু পেরিয়ে নগরীতে প্রবেশের পর পুরো নগরী অতিক্রম করে যেতে হত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। এতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগত। কেবল আনোয়ারা নয়, বাঁশখালী ও লোহাগাড়ার বাসিন্দাদেরও এভাবে বিমানবন্দর যেতে হত।
টানেল খোলার পর আনোয়ারা সদর থেকে টানেল পেরিয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেতে সময় লাগবে সব মিলিয়ে ১৫ মিনিট। এরমধ্যে টানেল পার হতে সময় লাগবে সাড়ে তিন মিনিট।
টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তের অদূরে চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি খুলে দেওয়া হলে সেখান থেকে নগরীর আগ্রাবাদ বা জিইসি মোড় যেতে লাগবে আর ১০-১৫ মিনিট সময়। এক্সপ্রেসওয়েটির কাজ শেষ পর্যায়ে।
কেইপিজেড থেকে টানেল হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাবিত বে টার্মিনালে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১০-১৫ মিনিট। আর কেইপিজেড থেকে টানেল হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে যেতে লাগবে ১৫-২০ মিনিট।
এই টানেল কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে চট্টগ্রাম শহর এবং আনোয়ারার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ তৈরি করেছে। এতে চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে ঢাকা বা দেশের যে কোনো এলাকা থেকে কক্সবাজার বা দক্ষিণ চট্টগ্রামমূখী যানবাহন চলাচলের সময় ও দুরত্ব কমে আসবে।
চট্টগ্রাম শহরের নেভাল একাডেমি পয়েন্ট দিয়ে যানবাহন প্রবেশ করে কর্ণফুলীর ওপারে আনোয়ারা উপজেলার কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) এবং চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) মাঝামাঝি দিয়ে বের হবে।
আনোয়ারার বারাশত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম এ কাইয়ুম শাহ বলেন, টানেলের কারণে শুধু যাতায়াতের সময় কমেছে, তা নয়। টানেলের কারণে কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত ছয় লেইনের সড়ক হয়েছে।
এলাকায় জমির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। টানেল খোলার পর পারকি বিচে পর্যটক বহু গুণ বাড়বে। ব্যবসা ও জীবনযাত্রার মান বাড়বে টানেলের কারণে। তবে যানজট নিরসন, ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান ও শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাস্টারপ্ল্যান করে আনোয়ারায় নগরায়ন করতে হবে।
কর্ণফুলী নদীর ওপর রয়েছে তিনটি সেতু। নদীর তলদেশে পলি জমা বড় সমস্যা। বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ ভেড়াতে ন্যূনতম ১৪ মিটার গভীরতা দরকার হয়। কিন্তু পলি জমার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমের জন্য তা হয়ে উঠছে সমস্যার।
টানেল আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ভারী শিল্প এলাকা। সিইউএফএল এবং কাফকো ছাড়াও দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি শিল্প কারখানা কোরিয়া ইপিজেড। এই শিল্পাঞ্চল থেকে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়।
আনোয়ারায় প্রস্তাবিত ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে জি টু জি পদ্ধতিতে গহিরা এলাকায় ৭৭৪ একর জমিতে চায়না অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এতে ৩৭১টি শিল্প কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে।
কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে বাড়ছে শিল্পায়ন। পর্যটন শহর কক্সবাজারগামী পরিবহনের চাপও বাড়ছে। ফলে নাব্যতা হারানোর ঝুঁকিতে নদীর উপর আর কোনো সেতু নির্মাণ না করে যানবাহনে চলাচলে গতি আনতে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা টানেল হওয়াতে কর্ণফুলী-আনোয়ারার জনসাধারণ চট্টগ্রাম ১৩ আসনের সংসদ সদস্য ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি’র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, চীনা সহযোগিতায় নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল। ঠিকাদার ছিল চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। সময় লেগেছে ছয় বছর, ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। টানেলের অবস্থান কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায়। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩১৫ কিলোমিটার, প্রস্থ ৩৫ ফুট, উচ্চতা ১৬ ফুট। ১১ মিটার ব্যবধানে টানেলে আছে যাওয়া ও আসার জন্য দুটি টিউব। টিউবের দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তে আছে ৫.৩৫ কিলোমিটার এপ্রোচ রোড। টানেলের ভেতরে গাড়ি ছুটবে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে। টানেলের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর। ৫ বছর মেনটেইনেন্স ও অপারেশন দেখবে চীনা কোম্পানি সিসিসিসি।
টোল দিতে হবে গাড়ির ধরন অনুযায়ী ২০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা। আপাতত টানেলে কোনো থ্রি হুইলার বা মোটর সাইকেল চলবে না। পায়ে হেঁটে কেউ টানেলে যাতায়াত করতে পারবেন না।
২০০৮ সালে চট্টগ্রামবাসীকে এই টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুরুর দিকে সেই প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক বুলি মনে হলেও তা এখন বাস্তব হয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কাজের উদ্বোধন করেন।
প্রকল্পের মোট ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ বলেন, যেসব কাজ বাকি আছে, তা টানেলের বাইরের অংশে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই সেসব কাজ শেষ হবে।