জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখরের একটি লেখায় তিনি বলেছিলেন, আমরা যেন তিনটি ‘ ম ‘ এর উপর আস্থা না হারাই। এই তিনটি ‘ ম ‘ হলো মা, মাতৃভাষা এবং মুক্তিযুদ্ধ। যখনই মা, মাতৃভাষা এবং মুক্তিযুদ্ধ এই শব্দবন্ধ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তখনই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আমাদের সামনে প্রতীয়মান হয়ে উঠে। আর বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য প্রসঙ্গ এলেই উজ্জ্বল যে দুজন নক্ষত্রের নাম স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠে তাদের একজন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যজন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুমাত্র একজন কবিই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার ও সুরকার, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, সাংবাদিক, রাষ্টচিন্তাবিদ সহ বহুমুখী প্রতিভার অনন্য উদাহরণ।
একই সাথে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও ছিলেন বাস্তবিক অর্থেই আশ্চর্য প্রতিভার অধিকারী অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। যাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে শোষিত নিপীড়িত মানুষের কথা। যিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছেন বিদ্রোহী কবি, মানবতার কবি, সাম্য, প্রেম ও দ্রোহের কবি অভিধায়। তিনিও ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সাংবাদিক,গীতিকার ও সুরকার, রাষ্ট্র এবং সমাজচিন্তক।
আমার আজকের লেখা মূলত সমকালীন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। সমকালীন বাংলাদেশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য চর্চার বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা নির্ণয়, তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও রাষ্টচিন্তার সমন্বয়সাধন। যা বর্তমান পরিস্থিতিতেও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
রাষ্টবিজ্ঞানী এরিস্টটল বলেছিলেন,রাষ্ট্র প্রকৃতিরই অবদান এবং মানুষ হচ্ছে প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। একথাটি সর্বাংশেই সত্য। পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ নেই যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নয়। আমরা যতই বলি আমি কোন রাজনীতি করিনা বা কোন ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাস লালন করি না, তারপরও আমাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন রাজনৈতিক আদর্শকে ধারন করি। অনেকক্ষেত্রে আমাদের অজান্তেই আমরা কোন না কোন রাজনৈতিক শক্তির অংশ হয়ে যাই। তাঁরপরও যাঁরা রাষ্টের কল্যাণকামী তাঁরা সবসময় নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন। এই নিরপেক্ষতা বলতে বুঝায় নিজের লালিত আদর্শকে চেপে রেখে সত্য ও সুন্দরকে ধারণ করা। এই নিরপেক্ষতা বলতে এটা বুঝায় না তিনি কোন রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাবপুষ্ট নয়।
কিন্তুু বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হয়ে উঠেছে,এখানে নিরপেক্ষতার ছিটেফোঁটাও নেই এখন। সবাই রাজনৈতিক আদর্শের ছাতার নিচে অবস্থান নিয়েছেন। সুবিধা মতো পথও বেচে নিচ্ছেন। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা খুব একটা ভাবনার বিষয় না হলেও জাতির বিবেক তথা নীতি নির্ধারক, সাংবাদিক, লেখক,বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের এই বহুমাত্রিক অবস্থান এবং জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে স্বার্থান্বেষী মহলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের এই প্রচেষ্টা জাতির জন্য ভয়ংকর অশনি সংকেত।
প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও দুর্নীতিবাজদের প্রভাবে আজ প্রগতিশীল, সৎ, আদর্শবান, দেশপ্রেমিকরা কোণঠাসা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিনত হয়েছে উচ্চতর মুখস্থবিদ্যার কেন্দ্রে,সার্টিফিকেট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং চাকুরী প্রত্যাশী প্রজম্ম ও বেকার তৈরীর কারখানায়। উপযুক্ত গবেষণার পরিবেশ তৈরীর অভাব,বিজ্ঞানমুখী প্রজম্ম তৈরী করতে না পারার ব্যর্থতা, আকাশ সংস্কৃতির হিংস্র আক্রমণে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়া, দুর্নীতির মহামারী আকার ধারন, সাহিত্য ও দর্শন চর্চায় অনীহা, সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিস্তাররোধ করতে না পারার চক্রে বাংলাদেশ আজ ঘূর্ণমান।এদায় কোনভাবেই রাষ্টযন্ত্র তথা সরকার ও প্রশাসন এড়াতে পারে না।
একটি মহল সবসময়ই রাষ্টযন্ত্রকে ভুল পথে পরিচালিত করে। জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে হীন ব্যক্তি স্বার্থে দেশকে ব্যবহার করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যেহেতু আজকের আলোচনা রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সাহিত্যচর্চা,রাজনৈতিক দর্শন ও রাষ্টচিন্তার আলোকে সমকালীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা নির্ণয় সেহেতু রবীন্দ্রনাথের আমাদের সম্পর্কে করা নিচের মন্তব্যটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না,যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না,ভূরি পরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতা লাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স, এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তি বিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। ”
কবিগুরু কি সুন্দরভাবেই না বাঙ্গালির স্বরূপ তুলে ধরেছিলেন। যা আজও সমভাবে প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ একজন যুগাতিক্রমী দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ছিলেন ;তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দর্শন সমৃদ্ধ প্রবন্ধ ও লেখনী পড়লেই এটা বুঝা যায়। একারনেই বাঙ্গালির ক্ষোভ, বিক্ষোভ এবং বাঙ্গালির সংকট মুক্তির পথ প্রদর্শক
রূপে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তা বিশেষভাবে গুরুত্ববহন করে।
রবীন্দ্রনাথের মতে পরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স হলেও বর্তমানে তাঁরসাথে যুক্ত হয়েছে তেলবাজি। হুমায়ন আজাদ লিখেছিলেন, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। কিন্তুু তিনি ভুলেও ভাবেননি দেশ একদিন তেলবাজদের অধিকারে যাবে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে শিল্পী কামরুল হাসান এঁকেছিলেন, ” দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে। সমকালীন প্রেক্ষাপটে হয়ত আঁকতেন দেশ আজ তেলবাজদের খপ্পরে।
দেশের চতুর্দিকে তেলবাজদের এই বাম্পার ফলনের কারণে রাষ্টযন্ত্র ভুল পথে পরিচালিত হতে বাধ্য হচ্ছে। বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি,ডলার সংকট, রাষ্টের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিসহ নানাবিধ রাষ্ট্রীয় সমস্যার জন্য এরাই অনেকাংশে দায়ী। সরকারকে ব্যবহার করে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে এরাই সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল একটি ক্ষুধা মুক্ত, সাম্য ও ন্যায় ভিত্তিক, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। কিন্তুু সে স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে সেটা অবশ্যই প্রশ্নের দাবী রাখে। সরকার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতভাবে এসব তেলবাজদের পৃষ্ঠপোষক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, সবাই পায় সোনার খনি আমি পেয়েছি চোরের খনি। তিনি যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে দেখে যেতে পারতেন চোরের খনির পাশাপাশি তেলের খনিও এখানে আছে।
কাজী নজরুল বিপ্লবী গোপীনাথ সাহা, ক্ষুধিরাম বসু, সূর্যসেন, যতীন দাশ, মুজাফ্ফর আহমদ সহ আরো অনেক কমিউনিস্ট নেতাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। যদিও তিনি মার্কসবাদী কমিউনিজমের সমর্থক ছিলেন না তথাপিও তিনি সাম্য ও ন্যায়ের পক্ষে আপোষহীন কণ্ঠস্বর ছিলেন। জামাল উদ্দীন বারী তাঁর কবি নজরুলের চেতনা : অবক্ষয় ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির প্রতিপক্ষ শিরোনামে লেখা প্রবন্ধে লিখেছেন,ঔপনিবেশিক শোষণের নিগড় থেকে বেরিয়ে এসে শোষণ-বৈষম্যহীন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল কবি নজরুলের স্বপ্ন ও সাধনা। নজরুলের প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে এক বিরলপ্রজ সাযুজ্যের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তার কবিতা ও গানে যেভাবে অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটেছে চর্যাগীতিকার কবিদের থেকে শুরু করে অদ্যাবধি আর কোনো বাঙালি কবির মধ্যে এমন মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। জাতির এক চরম ক্রান্তিকালে হিন্দু ও মুসলমানের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভাবাবেগ তুলে ধরার এমন কৃতিত্ব একমাত্র নজরুলের।
তিনি শোষিত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ছিলেন, কোন প্রকার দালালী বা তেলবাজি না করে সাধারণের কথা লিখেছেন বলেই তিনি বারবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তার রাজনৈতিক জীবনের গল্প বিশাল। সে গল্প না হয় আরেকদিন লিখবো। সমকালীন লেখক ও সাংবাদিকদের জন্য নজরুলের মতো আপোষহীন , সত্যাশ্রয়ী হওয়ার কোন বিকল্প নেই। নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শ, দর্শন ও মুক্ত রাষ্টচিন্তার লালনই হতে পারে আমাদের জন্য নবদিগন্ত। তাঁর জন্য অবশ্যই তেলবাজ, দুনীতিবাজ আর অপশক্তির বিরোদ্ধে নজরুলের মতো দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারণ করতে হবে, ” মহা-বিদ্রোহী রণ -ক্লান্ত আমি সেইদিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবেনা।
লেখকঃ রেফায়েত উল্যাহ রুপক
তরুণ বিশ্লেষক ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক
শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।