বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বলা হয়ে থাকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে এই তরুণরাই জাতির কর্ণধার রূপে আবির্ভূত হয়। উচ্চশিক্ষা শেষে জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। অথচ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন না করার অবকাশ নেই। বরং এই মুহূর্তে সামগ্রিক যে চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে মনে হয় এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিণতি ” হীরক রাজার দেশ ” ছাড়া আর কিছুই নয়।
বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মাঝে তীব্র হতাশার পাশাপাশি দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন জাতীয় স্বার্থের চেয়েও হীন ব্যক্তি স্বার্থকে বড় করে দেখছেন। তাদের মাঝে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো সৎ সাহসের অভাব স্পষ্টত প্রতীয়মান।
এদিকে রাজনীতির প্রতি নতুন প্রজম্মের মাঝে নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে। সহিংসতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, তীব্র দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, তোষামোদ আর তেলবাজি রাজনৈতিক পরিবেশকে কুলষিত করছে। মেধাবীরা এখন রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করবে।দেশে এক গভীর নেতৃত্ব সংকট তৈরী হতে পারে!
ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীরা রাজনীতি বিমুখ হয়ে বেছে নিয়েছেন বিসিএস, ব্যাংক জব, সরকারি – বেসরকারি চাকুরি। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে কিছুটা স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করলেও বেশির ভাগ মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন এক বুক দুঃখ আর হতাশা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে জাতির অভিভাবক ভাবা হয়। তাদেরকে সর্বোচ্চ সম্মান আর মর্যাদা পাওয়ার একচ্ছত্র অধিকারীও মনে করা হয়। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কর্মকাণ্ড বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্ট করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আর রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্যদের স্থাপন এই অরাজকতাকে আরও উস্কে দিচ্ছে। এখন শিক্ষকরা গবেষণা, পড়াশোনা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ কার্যক্রমে সময় ব্যায়ের চেয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। এর নির্লজ্জ উদাহরণ সাম্প্রতিক মিছিল, সমাবেশে তাদের সামনের সারিতে অবস্থান।
এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়োগ পেলে ছাত্রনেতারা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে যেতেন। আর বর্তমানে নিয়োগ পেলে শিক্ষকরা কৃতঙ্গতা স্বরূপ নেতাদের কাছে ফুল ও মিষ্টি নিয়ে যান। এছাড়া আশির দশক কিংবা নব্বই এর দশকের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে যে সেতুবন্ধন ছিল তাও এখন অনুপস্থিত। তোষামোদী ও তেলবাজদের আধিক্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আজ পিষ্ট। শিক্ষার্থীদের অধিকারের প্রশ্নে কেউ একজন সোচ্চার হলেই তার উপর নেমে আসে নানামুখী চাপ। অনেক সময় তাকে বেয়াদব তকমা দিয়ে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ পরিবেশ তৈরীতে সবচেয়ে সহায়ক শক্তি হচ্ছেন জ্বি হুজুর শ্রেণির তেলবাজ শিক্ষার্থীরা। এরা অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করেনই না আবার প্রতিবাদকারী সাহসী ও সৎ শিক্ষার্থীদের পথকে অমসৃণ করতে কাজ করেন। যে কোন পরিস্থিতিতে এরা প্রতিবাদীদের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে দায় সারতে চায়। এছাড়া নিজের সহপাঠী বন্ধুর মনোবল ভেঙ্গে দিতে এরাই যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। তারা সবসময় বলবে তোদেরই দোষ। এরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে তো দাঁড়িয়ে কথা বলেই না বরং অন্যায়কে ন্যায় বলে প্রতীয়মান করতে চায়। এরাও এ অরাজকতার জন্য সমান ভাবে অপরাধী। এদের প্রতিই কবি ধিক্কার জানিয়ে লিখেছিলেন “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে তৃণ সম দহে। ”
এসকল তেলবাজ শিক্ষার্থীরা যখন রাষ্টীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয় তখন অতীতের ধারাবাহিকতায় এরাই দুর্নীতি, অপশাসন, আর দুঃশাসনের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হয়। যার প্রমান বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার এবং নানা অনিয়ম। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একদিন একটি বক্তব্যে বলেছিলেন, আমি তখন ঢাকা কলেজের শিক্ষক। একদিন আমারই কিছু শিক্ষার্থী ক্লাসের পাশ দিয়ে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ফলাফলধারী কয়েকজন বলে উঠলো স্যার দেখেছেন তারা কি করছে? তাদের জীবনটা এভাবেই শেষ হয়ে গেল! মারামারি করে, জেলে যায় আবার জেল থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামে। তখন আমি তাদের দিকে কয়েক মিনিট তাকিয়ে থেকে বললাম আমি তোমাদের ছিনি তাদেরকেও ছিনি। তোমরা পড়াশোনা করতে করতে একদিন সিএসপি অফিসার হবা, তারপর একদিন সচিব হবা আর তারা এগুলো করতে করতে একদিন মন্ত্রী হবে। তখন তোমরা তাদেরকে স্যার বলতে হবে। এরাই হচ্ছে আসল হিরো।
অথচ আজ মেধাবীরা রাজনীতির প্রতি বিরক্ত। এখনকার ছাত্রনেতারা সাহিত্য রাজনীতি,আইন, ইতিহাস, দর্শণের বই পড়েন না। তারা হোমওয়ার্ক করেন না। শুধুই মারামারি আর সহিংসতার রাজনীতি করেন। যার ফলে স্মার্ট, মেধাবী, প্রগতিশীল, এবং সম্মোহনী নেতৃত্বগুণ সম্পূর্ণ ছাত্র নেতা তৈরী হচ্ছে না। একদিন আমি একজন রাজনৈতিক নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই যে তরুণরা রাজনীতির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তার দায় কি আপনারা এড়াতে পারেন? তিনি সেদিন যে উত্তর দিয়ে ছিলেন তা কিছুটা হলেও যুক্তিসংগত। তিনি বলেছিলেন শুনো কোন কালেই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সাহস নিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সহজ ছিল না। এখন মেধাবীরা রাজনীতিতে আসতে চাচ্ছে না এটা সত্য। কিন্তুু তারপরও কেউ কেউ আসছে। যদিও এটা সংখ্যায় যথেষ্ট নয়। এধারার পরিবর্তন অবশ্যই জরুরি। কিন্তুু মনে রেখো যারা স্রোতের বিপরীতে গিয়ে সংগ্রাম করে তারাই ইতিহাসের অংশ হয় আর যারা অন্যায়ের পক্ষ নেয় তারাই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।
তরুণদের অবশ্যই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই পথ চলতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দেশ ও জাতির কল্যাণে অবিচল ভাবে লড়ে যেতে হবে। অন্যথায় তাদের পরিণতি হবে আস্তাকুঁড়েই। কার্ল মার্কস বলেছিলেন, এটাও ইতিহাসের শিক্ষা যে কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। যদি এমনটিই হয় যে তারা এঅবস্থার পরিবর্তন না করে এপথেই অবিচল থাকে তবে তাদেরকে ফিরানোর কোন পথই খোলা নেই। শুধু এটুকুই বলতে পারি ” ধিক তারে শত ধিক..!!
লেখকঃ রেফায়েত উল্যাহ রুপক
তরুণ বিশ্লেষক ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক
শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।