কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত বেরিবাঁধ কাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের ফলে বাড়ছে নগরের সৌন্দর্য। নগর রক্ষার পাশাপাশি এটি এখন ’পর্যটন স্পট’ এ পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন বিকেল হলে অনেকেই পরিবার নিয়ে প্রশান্তির জন্য বেড়াতে আসছেন এই স্পটে। বিশেষ করে সরকারি ছুটির দিনে থাকে লোকে লোকারণ্য। শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) নগরের শেষ প্রান্তে কর্ণফুলী নদীর কূল ঘেষে নির্মিত এই রাস্তাটি দেখতে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ছে। শরীর ও মনের ক্লান্তি দুর করতে অনেকেই ঘুরতে এসেছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক দর্শনার্থী।
জানা যায়, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে ২৭৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। এই সড়কের একপাশে রয়েছে চট্টগ্রাম শহর আরেক পাশে রয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহি কর্নফুলী নদী। নদীর দিকে তাকালে দেখা যায় পানির উপরে সারিসারি করে রাখা বিভিন্ন ধরণের মাছ ধরার নৌকা এবং ছোট ও মাঝারি জাহাজের সারি। আবার রাতের বেলা মনে হবে এটি যেন আরেকটি নগর। প্রতিটি জাহাজের ভেতরে জলন্ত বাতিগুলো যেন একেকটা অলো ঝলমলে বাড়ি। আবার নগরের প্রান্তে তাকালে দিনের বেলা ইটের তৈরি ভবনের সারি আর রাতের বেলা আলোকিত আধুনিক শহর।
ঘুরতে আসা রবিউল হোসেন নামের একজন জানান, এই এলাকাটি একসময় জঙ্গল ছিল, মাদক ব্যবসায়ী ও ব্যবহারকারীদের অভয়ারণ্য ছিল এই জায়গাটি। এমনকি এখানে কেউ আসলে ছিনতাইয়ের কবলেও পড়তে হতো অনেক সময় কিন্তু এই রাস্তাটির কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই এতদিকে যেমন অপরাধীরা পালিয়েছে অন্যদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে সৌন্দর্য। এখন পরিবেশটা খুব সুন্দর লাগছে। মিরাজ হোসেন নামের আরেকজন জানান, সড়কটি খুব সুন্দর লাগছে, রাস্তার পাশে লাগানো হয়েছে সারিসারি গাছের চারা। আরসিসিসি ব্লকগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে মনে হচ্ছে অতিথিদের বসার জন্য সারিসারি করে আসন পাতানো হয়েছে। যেখানে বসে কর্ণফুলী নদীর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করার আনন্দটাই আলাদা হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, জলাবদ্ধতার অভিশাপ ও যানজট মুক্ত নগর বিনির্মাণ ও শহর রক্ষার প্রয়োজনীয়তায় এই প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছাস ও বণ্যা থেকে শহরকে রক্ষা করার পেছনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখবে এই সড়ক। আবার অল্প সময়ের মধ্যে নতুন ব্রীজ টু কালুরঘাট যাতায়াত অনেক সহজ হবে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নগরবাসী এর সুফল ভোগ করতে পারবে। তবে কাজ শেষ হওয়ার আগেই এটি একটি বিনোদন কেন্দ্রে পরিনত হয়ে গেছে। এখনো বেশকিছু কাজ বাকি আছে, পুরো কাজ শেষ হলে বদলে যাবে চট্টগ্রামের দৃশ্যপট। তাঁরা জানা, ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ কাম সড়ক প্রকল্পটির নিচের অংশে ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট প্রস্থ এবং ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতা হবে। ফলে এটি শহর রক্ষা বাঁধ হিসেবে কাজ করবে। আর এটির সর্বমোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ১৭০ একর জমি একোয়ার করছে সিডিএ। এরমধ্যে ২০ শতাংশ জমি সরকারি মালিকানাধিন বন্দরের। বাকী ৮০ শতাংশ জমির মধ্যে এই পর্যন্ত ৭০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বাকিগুলো একোয়ারের প্রক্রিয়া চলমান।
এবিষয়ে কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) ও সিডিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব দাশ বলেন, ” জলাবদ্ধতা নিরসণ, শহর রক্ষা ও নগরের যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য এই প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল। পুরোপুরি সুফল পেতে আরো বছরখানেক অপেক্ষা করতে হবে। তবে কাজ করতে গিয়ে এলাকার পরিবেশের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। ফলে এখন অনেক লোক এখানে বেড়াতে আসছে। দেখে আমাদের ভালো লাগছে। নিজেও যখন প্রকল্প পরিদর্শনে যাই তখন প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যাই। সার্বিক বিবেচনা করে এখন আমরা রাস্তার পাশে কিছু গাছ লাগিয়েছি। আরো লাগানো হবে। ফলে একদিকে পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে, দর্শনার্থীরাও রোদের তীব্রতা থেকে রক্ষা পাবে। আবার ভাঙনরোধে বসানো ব্লকগুলোতে পর্যটকরা বসে সময় কাটাতে পারবে। প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে এর পুরো সুফল পাবে নগরবাসী এবং দর্শনার্থী সংখ্যাও বাড়বে বলে আশা করছি”।
উল্লেখ্য, নগরীর চাক্তাই, খাতুনগঞ্জসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকার জলবদ্ধতা নিরসনে ১২টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউজ স্থাপনের কথা রয়েছে প্রকল্পের অধীনে। বর্তমানে ১০টি খালের মুখে রেগুলেটর ও পাম্প হাউজ বসানের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি দুটি খালের মুখে রেগুলেটর বসানোর কাজ চলমান আছে। সিডিএ’র এই প্রকল্পের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিল একনেক সভায় এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর কাজ শুরু করে সিডিএ। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর তিন দফা প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর ব্যয় বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। এরই মধ্যে ব্যয় না বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে।