
যারা ঢোট চান না তারা গণতন্ত্রও চান না, তাদের তো কেউ রাজনীতি করতে বলেনি বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে কেউ যদি সরে দাঁড়াতে চায়, তাদের মেসেজ দিতে হবে বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়, বাংলাদেশের মানুষ তার দেশের মালিকানা ফিরে পেতে চায়। আর আপনারা যারা গণতন্ত্র চান না, তাদের তো কেউ রাজনীতি করতে বলেনি। আপনারা যারা ভোট চান না, তাদের রাজনৈতিক দল করার দরকার কী! নির্বাচন করবেন না, আবার বলবেন আমি রাজনৈতিক দল, জনগণের কাছে যেতে চাইবেন না, আবার বলবেন আমি রাজনৈতিক দল, তো আপনি রাজনৈতিক দল হলে তো জনগণের কাছে যেতে হবে। এটাই তো রাজনীতি।
তিনি শনিবার (১৯ জুলাই) দুপুরে নগরীর লালখান বাজার সংলগ্ন লেডিস ক্লাবে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখার ত্রি বার্ষিক সন্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শিক্ষক সমিতির আহবায়ক ও বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম টিপুর সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব মোহাম্মদ মোবারক আলী এবং খন্দকিয়া চিকনদন্ডী স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহিদা আক্তারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সন্মেলনে প্রধান বক্তার বক্তব্য রাখেন শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সেলিম ভূইয়া। সন্মেলনের উদ্বোধন করেন শিক্ষক সমিতির মহাসচিব ও শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোটের অতিরিক্ত মহাসচিব মো. জাকির হোসেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি, শিক্ষক সমিতির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঐক্যজোটের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এম এ ছফা চৌধুরী, শিক্ষক সমিতির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঐক্যজোটের কক্সবাজার শাখার সভাপতি হোসাইনুল ইসলাম মাতব্বর।
আমীর খসরু বলেন, সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, ঐক্যমতের কথা বলা হচ্ছে, সব ঠিক আছে, সেখানে যতটুকুতে ঐক্যমত্য হবে তার বাইরে সময় নষ্ট না করে, লন্ডনে আমাদের তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের যে মিটিং হয়েছে, সেই মিটিং অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মালিকানা তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। এর বাইরে আর কোনো পথ নেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ চায়, একটি সহনশীল বাংলাদেশ চায়, পরস্পর সম্মানবোধের জায়গায় যেতে চায়, একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চায়। বাংলাদেশের মানুষের সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চায়। সুতরাং একটাই পথ, দ্বিতীয় আর কোনো পথ নেই, দেশের মালিকের ভোটে নির্বাচিত সংসদ ও সরকার, এর কোনো ব্যতিক্রম নেই।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষার প্রেক্ষাপট আমাদের আগে বুঝতে হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, শিক্ষক, রাষ্ট্র, সমাজ ও শিক্ষার্থী এই চতুর্মুখী সম্পর্কটা আমরা এখনো ধরতে পারিনি। শিক্ষানীতি করতে হলে আগে এই সম্পর্কগুলো স্পষ্ট করতে হবে। কারণ শিক্ষকই ভবিষ্যতের নাগরিক তৈরি করেন।
আমীর খসরু বলেন, একজন শিক্ষক সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। গ্রামের বা শহরের মানুষ তাকে চেনে, সম্মান করে। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষক মা বাবার পরেই শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু সেই মর্যাদা আজ সমাজে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা যদি সত্যিই শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চাই, তবে প্রথমেই শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান ও সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে।
তিনি অভিযোগ করেন, দেশে বর্তমানে শিক্ষকরা আর্থিকভাবে অবহেলিত। রাষ্ট্রের অন্য কর্মচারীরা নানা রকম সুযোগ সুবিধা পেলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয় না। সরকারি বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে, তা অযৌক্তিক। একই সিলেবাস, একই উদ্দেশ্যে যদি দুই পক্ষই পড়ায়, তবে আর্থিক বৈষম্য কেন থাকবে?
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা রাজনীতিকরণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন এই বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, গত ১৫-১৬ বছরে শিক্ষা একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার, একটি দল এবং তাদের আদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এটি ভয়াবহ। শিক্ষা কখনো কোনো দলের হয়ে কাজ করে না। শিক্ষা হবে জাতি গঠনের প্রধান হাতিয়ার।
নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এখনও আমি মনে করি, আমরা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ঐক্যবদ্ধভাবে সেই নির্বাচনকে সফল করার জন্য, একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আমাদের সকলকে মিলে কাজ করতে হবে। আসুন, সবাই মিলে আমরা আগামীদিনের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিই।
বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘসময় অপেক্ষা করছে ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য। সুতরাং আমাদের নির্বাচনের দিকেই যেতে হবে। মানুষ যদি বিএনপিকে ভোট দেয়, তাহলে দেবে, আর না দিলে যাকে ভোট দেয় সেটা আমরা মেনে নেব, কিন্তু নির্বাচন হোক। আমরা আমাদের সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে চাই। আমি আমার নাগরিক অধিকার ভোগ করতে চাই।
মানুষের প্রত্যাশা আকাঙ্খাকে ধারণ করে রাজনীতি করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা বদলে গেছে, আকাঙ্খা বদলে গেছে। সেটা ধারণ যদি কোনো রাজনৈতিক দল করতে না পারে, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব করতে না পারে, তাদের কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে নেই, আমি বলে দিলাম। ওটা ধারণ করে মানুষের প্রত্যাশা, মানুষের আকাঙ্খা পূরণে নতুন রাজনীতি করতে হবে।
তিনি বলেন, বক্তৃতার পর বক্তৃতা কেউ শুনবে না। মানুষের সময়ের মূল্য আছে, এটা সবাইকে বুঝতে হবে, রাজনীতিবিদকে বুঝতে হবে, শিক্ষককে বুঝতে হবে, সবাইকে বুঝতে হবে। এই যে পরিবর্তনের রাজনীতি সেই রূপরেখা আমাদের তারেক রহমান সাহেব দিয়েছেন। সেই পরিবর্তনের আশা আছে বলেই রাজনীতিতে আছি। না হলে, আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি, আমার তো অবসরে যাওয়া দরকার, রাজনীতি করার দরকার কী! কিন্তু আগামীদিনে নতুন বাংলাদেশের যে রূপরেখা, নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে আকাঙ্খা, ওই আশা থেকেই এখনও রাজনীতিতে আছি।
নির্বাচিত সরকার ছাড়া মানুষের কাঙ্খিত পরিবর্তন আসবে না জানিয়ে আমীর খসরু বলেন, সেই পরিবর্তনের জন্য একটা নির্বাচিত সরকার তো লাগবে। ইন্টেরিম সরকার তো আর এগুলো করার জন্য আসেনি, আসার কথাও না, আমি তাদের দোষও দেব না। এটা একটা অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের কাজ হচ্ছে কিছু নির্বাচনি সংস্কার করে একটা নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করা। যে পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক অর্ডার চালু হবে, আমরা যাদের দেশের মালিক বলে থাকি, সেই মালিকের ভোটে নির্বাচিত সংসদ হবে, সরকার হবে, সেই সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, জবাবদিহি থাকবে। এখন তো সেটা নেই।
আমীর খসরু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারতো রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বশীল সরকার নয়, এটা তাদের সীমাবদ্ধতা। সুতরাং তাদের দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দেশটাকে তার মালিক জনগণের হাতে তুলে দেওয়া দরকার। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে চলবে। পরিবর্তন কী হবে, এদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়া বলেন, প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় সরকারি স্কুল ছাড়া আর কোন স্কুলের শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পাররে না বলে কয়েকদিন আগে সরকার যে সার্কুলার জারি করেছে তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যাবেনা। কারণ দেশে বোর্ড থেকে অনুমোদন দেওয়া অনেক প্রাইমারি ও উচ্চ বিদ্যালয়ের শাখা আছে। সুতরাং আগে যেহেতু সরকারি বেসরকারি স্কুল থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছে, এখন কোন সুযোগ নাই বেসরকারিদের বাদ দিয়ে শুধু সরকারি স্কুলের পরীক্ষা নেওয়ার। আমরা এই বিষয়ে উপদেষ্টা ও সচিবের সাথে কথা বলবো, যদি তারা কোন ব্যবস্থা না নেয় তাহলে আমরা আদালতে যাবো।
তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সবার প্রত্যাশা ছিল একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের। তারেক রহমানও নির্দেশ দিয়েছেন তাদেরকে সহযোগিতা করার। আমরা সেভাবেই সরকারকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি। কিন্তু আমরা দেখলাম, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ডুকে গেল অন্য দলের কিছু লোক। বদলী সংক্রান্ত দায়িত্ব দেওয়া হলো একটি মৌলবাদী দলের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সভাপতিকে। সে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি জায়গায় তার দলের লোকদের বসিয়ে দিয়েছে। বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে সেখান থেকে এখন আর উত্তরণের সুযোগ পাচ্ছি না।
এতে বক্তব্য রাখেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপির আহবায়ক অধ্যাপক কুতুবউদ্দিন বাহার, শিক্ষক নেতা মো. হাবিব উল্লাহ, সিটি করপোরেশন কলেজ সমিতির আহবায়ক আবদুল হক, চট্টগ্রাম জেলা কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নুরুল আলম রাজু, সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দীন, শিক্ষা বোর্ড কর্মচারী সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিন, শিক্ষক সমিতি সন্দ্বীপ উপজেলার সদস্য সচিব ফজলুল করিম সাঈদ, সীতাকুণ্ডের সভাপতি আবু জাফর মো. সাদেক, মিরসরাইর আহবায়ক রেজাউল করিম, ফঠিকচড়ির সদস্য সচিব মো. আলমগীর, হাটহাজারীর আহবায়ক গিয়াস উদ্দিন, রাউজানের আহবায়ক মো. জামাল শাহ, রাঙ্গুনিয়ার সভাপতি মো. আইয়ুব।