
চলতি বছরের ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন করা হলেও এই বছর (২০২৩ সালে) বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন কক্সবাজার যাবেনা। অভিযোগ রয়েছে বাণিজ্যিক বিভাগের অফিসিয়াল কার্যক্রমও শেষ হয়নি। শুধু তাই নয় সিগন্যালিং বিভাগের কাজও ঝুলে আছে। হাতির পালের জন্য ওভারপাস করা হলেও রেল লাইনের উপর দিয়ে হাতি পারাপারের সম্ভাবনা। ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রায় সাড়ে ৫০০ টনের লোড নিয়ে যাত্রীবাহি কোচের দূর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা অনেক। সব কাটিয়ে ২০২৪ সালের আগে ট্রেনে করে যাত্রীরা কক্সবাজার যেতে পারবেনা বলে বিশ্বস্ত একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।
আরো অভিযোগ রয়েছে, গত ২ মাস আগেও যেখানে লাইন ধসে গেছে পানির তোড়ে, সেখানে দীর্ঘ প্রায় ৫ বছরের স্থাপনা মাত্র দুই মাসে মেরামতের বিষয়টি নিয়ে খোদ ট্রাফিক বিভাগও টেনশানে আছে। পরিচালন বিভাগের একটি সূত্র বলছে, সম্পূর্ণ লোডের ট্রায়াল রান ছাড়াই কক্সবাজার রুটের ট্র্যাকের উপর কিভাবে ট্রেন যাবে ৮০কিমি. গতিতে তা হবে আত্মঘাতি।
মুঠোফোনে ট্রেনের লোড ট্রায়াল ও অসমাপ্ত কাজ প্রসঙ্গে দোহাজারী- কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক সবুক্তগীন বলেন, এসব প্রশ্ন ট্রাফিক বিভাগ ও রেলের জিএমকে করবেন। আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না। ট্রায়াল কেন হয়নি বা কি হয়েছে তা আমার জানার বিষয় নয়। অসমাপ্ত কাজ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন উত্তর না করে তাঁর ইচ্ছেমতো প্রতিবেদকের কলটি বাতিল করে দিয়েছেন।এ ব্যপারে রেলওয়ে পুর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মো. নাজমুল ইসলামের মোবাইল নাম্বারে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি পরবর্তিতে কোন সাড়াও পাওয়া যায়নি।
আরো অভিযোগ রয়েছে, ট্রাফিক বিভাগের স্বল্প লোডে ট্রায়ালের নামে বাস্তবে ট্রেন গেলো সৈকত নগরী কক্সবাজারের আইকনিক রেল স্টেশনে। গত ৫ নভেম্বর প্রকল্প পরিচালক, রেল ট্র্যাকের রক্ষক প্রধান প্রকৌশলী, ট্রেন পরিচালনাকারী সিওপিএস সহ অন্যান্যরা। নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে এমন অসমাপ্ত প্রকল্পের উদ্বোধন পর্যটকদের ভাবিয়ে তুলছে। কারণ অসমাপ্ত প্রকল্পের ঝুঁকিবিহীন নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউই।
এদিকে, আগামী ১১ নভেম্বর দোহাজারী-কক্সবাজার রেল চলাচল উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে গত ৫ নভেম্বর সাড়ে ৫০০টন লোডের স্থলে সাদামাটা ট্রায়াল রানে (পরীক্ষামূলক চলাচল) সম্পন্ন করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এমন একটি কৌতুহলী পরিদর্শন সম্পন্ন করেছেন জিআইবিআর প্রধান রুহুল কাদের আজাদসহ সংশ্লিষ্টরা।
প্রত্যক্ষভাবে হিসেব কষে দেখা গেছে, আন্তঃনগর ট্রেনগুলো যেখানে ১৬ থেকে ১৮টি কোচ নিয়ে ঢাকা- চট্টগ্রামের মধ্যে চলাচল করছে সেখানে মাত্র ৮টি কোচ নিয়ে পরিকল্পিত ট্রায়াল রান করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে। তবে তা আত্মঘাতি বলে দাবি করছেন রেল পরিচালনায় থাকা অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা। কালের স্বাক্ষী হিসেবে এই পরিদর্শনে বিভিন্ন অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীদের নিয়ে মাইলফলক তৈরী করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন প্রকল্প পরিচালকসহ রেলের পূর্বাঞ্চলীয় জেনারেল ম্যানেজার।
মেকানিক্যাল বিভাগের লোকোমটিভস মেইন্টিনেন্স তথা লোকোসেড সূত্রে জানা গেছে, ৩০০০ সিরিজের লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিনের লোড ৯৬ টন, ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিনের লোড ৭২ টন এবং ২২০০ সিরিজের ইঞ্জিনের লোড ৪৮ টন। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত প্রতিনিয়ত হেলেদুলে কালুরঘাট ব্রীজের উপর দিয়ে যাচ্ছে ২২০০ সিরিজের লোকোমোটিভস। কিন্তু কক্সবাজার রুটের জন্য কালুরঘাট ব্রীজের উপর ২২০০ সিরিজ ছাড়াও ২৯০০ ও ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনের ট্রায়াল দিয়ে দেখা হয়েছে। এতে সন্তুষ্ট প্রকল্প পরিচালক সবুক্তগীন ছাড়া অন্যান্যরা। কিন্তু কক্সবাজার রুটে চলাচল করবে ৩০২১ থেকে ৩০৩০ সিরিজের এসি কেবিনের লোকোমোটিভস যার ওজন প্রায় ৯৬ টন।
রেলওয়ে কারখানার ক্যারেজ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শুধু ওজনের ইঞ্জিন ছাড়াও প্রত্যেকটি আরো প্রায় ৩০ টন ওজনের কোরিয়ান মোট ১৫টি কোচ যুক্ত থাকবে যার ওজন প্রায় ৪৫০ টন। তাছাড়া লাগেজ ছাড়া ৫৫টি আসনের ১৫টি কোচের মানুষের ওজন গড়ে ৫০ কেজি হিসেব করা হলেও যাত্রীদের মোট ওজন প্রায় ১টন। কক্সবাজার ট্র্যাকের উপর সর্Ÿোচ্চ ৮০ কিমি. গতিতে ছুটে চলা ট্রেনের লোড প্রায় সাড়ে ৫০০টন।
অভিযোগের শেষ নেই, গত ৫ নভেম্বর ট্র্যাক ট্রায়ালে অত্যধিক কম ওজনের ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিন ও ৮টি কোচ (৮/১৬) নিয়ে প্রায় ১০০ যাত্রীর ট্রায়াল রান চালানো হয়েছে। রেলওয়ে পুর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম, প্রকল্প পরিচালক সুবক্তগীন, অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম চৌধুরী, রেলওয়ে পুর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিয়াসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাগণ এসময় উপস্থিত ছিলেন। প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে ৪ নভেম্বর ২২০০, ২৯০০ ও ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিন চালিয়ে শুধুমাত্র মেরামত করা কালুরঘাট সেতুর উপর পরীক্ষা চালিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বাণিজ্যিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ট্রেনের নাম বা ভাড়া এখনো চুড়ান্ত হয়নি। আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করবেন। ২২০০ থেকে ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিন দিয়ে ১৫ টি কোচ নিয়ে নিয়মিত ট্রেন চলাচল করবে। এরই সূত্র ধরে তড়িঘড়ি করে দায়সাড়া গোছের ট্রায়াল রান সম্পন্ন করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। ১৫ কোচের একটি ট্রেনে কমপক্ষে সাড়ে ৮০০ যাত্রী থাকে।
উল্লেখ্য, ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনের লুপ ট্র্যাকসহ ১৪১ কিলোমিটার রেললাইন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার। শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়।