নির্বাসন কিংবা দীর্ঘ কারাবাসই রাজনৈতিক জীবনের ইতি নয়। ইতিহাসে এমন বহু উদাহরণ রয়েছে, যেখানে কঠিন দমন–পীড়ন ও নির্বাসনের পর নিজ দেশে ফিরে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছেন বিশ্বনেতারা। জনগণের সমর্থন, আদর্শিক দৃঢ়তা ও দীর্ঘ সংগ্রামের শক্তিতে তারা রচনা করেছেন নতুন ইতিহাস। এমনই বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতার ফিরে আসার গল্প সারাবিশ্ব জানে। তারা হলেন পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো, ইরানের আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি, রাশিয়ার ভ্লাদিমির লেনিন, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ফ্রান্সের নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। এই তালিকায় নাম লেখালেন বাংলাদেশের তারেক রহমান।
২০২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর-এক মহানায়কের রাজসিক প্রত্যাবর্তনের দিন। এই দিনটি ইতিহাসে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিল। ৬ হাজার ৩শ ১৪ দিনের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার দেশের মাটিতে পা রাখলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনা তারেক রহমান কে রাজনীতি থেকে দুরে রাখতে সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিলো। মিথ্যা মামলায় সাজা প্রদান, মিডিয়া দিয়ে নানারকম গুজব, নানারকম মুখরোচক মিথ্যা কল্পকাহিনী বানিয়ে প্রচার করেছিলেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। মহান স্বাধীনতার ঘোষক, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ও সাবেক তিন বারের প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া'র সুযোগ্য সন্তান নিজ মেধা মননে আজ বাংলাদেশের নেতায় পরিণত হয়েছেন।
২৫ ডিসেম্বর ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের আকাশ যেন অপেক্ষার ভারে নুয়ে পড়েছিল। প্রায় ১ লাখ ৫১ হাজার ৫৩৬ ঘণ্টা লন্ডনে নির্বাসিত থাকার পর সপরিবারে দেশে ফেরেন তারেক রহমান। ঢাকায় হযরত
ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বিএনপির শীর্ষ নেতাকর্মীরা।
তারেক রহমান যখন দেশের মাটিতে পা রাখলেন, তখন তা কেবল একজন মানুষের ফেরা ছিল না-ফিরে এসেছিল স্মৃতি, প্রত্যাশা আর অসমাপ্ত স্বপ্নের দীর্ঘ সারি।
তারেক রহমান দেশের মানুষের কাছে এক আবেগের নাম। জীবনের ১৭টি বছর ছিলেন দেশছাড়া। কিন্তু অন্তরে লালন করেছেন নিজ দেশকে, জন্মভূমিকে। তাই তো দেশের মাটিতে শুরুতেই খালি পায়ে দাঁড়িয়ে জুড়িয়ে নিয়েছেন মন-প্রাণ। এক মুঠো মাটি তুলে নেন, মাটির গন্ধ নিয়েছেন নিজ শরীরে। আবেগে ছুঁয়েছেন দেশের মাটি। বিমানবন্দর থেকে বরণস্থল- সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটের পথ। কিন্তু সেই পথ পেরুতেই লেগে গেছে তিন ঘণ্টা।
১/১১ সরকারের সময় প্রায় ১৮ মাস কারান্তরীণ থাকাকালে রিমান্ডে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্নিকটে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সপরিবারে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান।বিদেশে যাওয়ার পর পলাতক হাসিনা সরকার তাকে দেশে আসতে দেয়নি। অবশেষে যখন তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ঘটল, তখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেত্রীসহ অনেক নেতাকর্মীই পলাতক। পলাতক খুনী হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র করেও তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে পারেনি। উল্টো ৮ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে বীরের বেশে মাতৃভূমিতে পা রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয় রাজধানীর পূর্বাচলে ৩০০ ফিট এলাকায়। তাঁকে স্বাগত জানাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বর্ণিল সাজে ব্যানার ফেস্টুন হাতে জড়ো হয় লাখ লাখ মানুষ। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলের ৩০০ ফুট স্বাভাবিক দিনে যে পথে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না, সেই পথেই লেগে গেল তিন ঘণ্টা। কারণ, রাস্তার দুই ধারে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সারি, মানুষের ঢল। কেবল নেতা-কর্মী নন, অনেকেই এসেছেন ১৭ বছর পর দেশে ফেরা তারেক রহমানকে একপলক দেখতে, যার বক্তব্য শুনে এদেশের জনগণ ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নেমেছিলেন। যার নেতৃত্বে বার বার রাজনৈতিক পরাজয় বরণ করেছিল হাসিনা গং। যার দৃঢ় নেতৃত্বের কাছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিএনপি ভাঙার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেল।
বিএনপির দলীয় পতাকার রং লাল-সবুজে সাজানো একটি মিনিবাসে করে দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে তারেক রহমান রওনা হন পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কের সংবর্ধনা মঞ্চের দিকে। সদ্য জাপান থেকে আনা বুলেটপ্রুফ বাসটির গায়ে লেখা ছিল ‘সবার আগে বাংলাদেশ’। বাসের সামনের অংশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে তিনি নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছা জানান। সেই উত্তরার জসীমউদ্দীন রোডের মোড় থেকে শুরু করে কাওলা, নিকুঞ্জ, খিলক্ষেত, কুড়িল বিশ্বরোড হয়ে সংবর্ধনা মঞ্চ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা নেতা-কর্মী, সমর্থকদের স্লোগান 'বীরের বেশে আসছে ফিরে তারেক রহমান", 'মা মাটি ডাকছে - তারেক রহমান আসছে' মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
পূর্বাচলের ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ে (৩০০ ফুট সড়ক) সকাল থেকেই লোকারণ্যে পরিণত হয়। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে সংবর্ধনা মঞ্চ পর্যন্ত পুরো সড়ক নেতা-কর্মীদের পদচারণে মুখর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নেতা-কর্মী, সমর্থকসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ আগের রাতেই মঞ্চ ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন। তারেক রহমানের আগমন উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে নানা স্লোগানসংবলিত ফেস্টুন, ব্যানার লাগানো হয়। লাখো লাখো নেতা-কর্মী কিন্তু কোন বিশৃঙ্খলা নাই, এমন বিএনপি ই জনগণের চাওয়া। এ এক নতুন বিএনপি, নতুন পথচলা আগামীর বাংলাদেশ বির্নিমানে।
কেবল পূর্বাচলের সংবর্ধনা মঞ্চ এবং তার আশপাশের এলাকাই নয়, মানুষের জমায়েত ছিল বনানী, গুলশান, বাড্ডা সড়কেও। কোথাও কোথাও ভিড় উপচে পড়ে। রাস্তাজুড়ে ছিল সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সতর্ক অবস্থান।
বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলের সংবর্ধনা মঞ্চ পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার পথ যেন লোকারণ্য হয়ে ওঠে। দেশকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। দেশের মানুষকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা তার। দেশের মাটিতে ফিরতে পারবেন কিনা- তা নিয়েও ছিল নানা অনিশ্চয়তা। ছিল জল্পনা-কল্পনা। সব জল্পনার ইতি ঘটিয়েছেন বড়দিনে। দিনটি শুধু বড়দিন নয়, তারেক রহমানের ফেরার শুভ দিনও।
জনজোয়ার ঠেলে বিকেল প্রায় চারটায় তারেক রহমান পূর্বাচলের জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ের সংবর্ধনা মঞ্চে ওঠেন, ১৬ মিনিট বক্তব্য দেন। তিনি সকলের জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানান।
দেশের ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি চোখ তখন তারেক রহমানের দিকে। কেউ মোবাইল ফোনে, কোথাও কোথাও বড় পর্দায়, আর ঘরে ঘরে টিভিতে তারেক রহমানের প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল এই ৩৬ কোটি চোখ। পুরো বক্তব্যের সময়টুকু সারা দেশ ছিল নীরব নিস্তব্ধ। তারেক রহমানও এর প্রতিদান দিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে। দেশে এসে প্রথমেই অসুস্থ মাকে না দেখে তিনি ছুটে গেছেন জনতার কাছে। জনতার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে। তার মুখে উঠে আসে শান্তির কথা। সকল দল, মত, জাতি, ধর্মনির্বিশেষে সকলকে নিয়ে শান্তির দেশ গড়ে তোলার কথা। মহান সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করেছেন বারবার। এ যেন এক বাংলার লুথার কিং। ১৯৬৩ সালের ২৮শে আগস্ট। এরপর ২০২৫-এর ২৫শে ডিসেম্বর। সময়ের দৌড়ে ৫৮ বছর। প্রায় ছয় দশক আগে একটি স্লোগান, একটি আওয়াজ সকলের নজর কেড়েছিল। আবেগে নাড়া দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে। ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষের সামনে শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় উদার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’। আমার একটি স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্নের কথা বলেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে বিশাল জনস্রোতে লুথার কিং জুনিয়রের ভাষণ ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল আমেরিকার তৎকালীন শাসকদের। প্রায় ছয় দশক পরে একই আওয়াজ দেশের মানুষ শুনতে পেয়েছে ঢাকার সন্নিকটে পূর্বাচলে। সতের বছর পর দেশের মাটিতে পা দিয়ে ১৬ মিনিটের বক্তৃতায় তিনি মার্টিন লুথার কিংকে স্মরণ করে বলেছেন, ‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান’। আমার একটি পরিকল্পনা আছে। আমেরিকার লিংকন মেমোরিয়ার কিং থেকে ঢাকার পূর্বাচল। একই প্রতিধ্বনি। লাখো মানুষের জনস্রোতে তারেক রহমান শুনিয়েছেন শান্তির বাণী। দিয়েছেন, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার ডাক। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকলকে নিয়ে দেশ গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বরণ মঞ্চে তখন উপস্থিত বিএনপি শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে অন্যান্য দলের শীর্ষ নেতারা তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন তারেক রহমানের কথা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে প্রতিধ্বনিত হয়েছে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা; দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত হয়েছে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার অঙ্গীকার। দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ ও প্রশস্ত সড়কে অবিশ্বাস্য সংখ্যক মানুষের এই সুশৃঙ্খল মিলনমেলা, যেখানে জনভোগান্তি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রেখে রাজধানীকে কার্যত সচল রাখা সম্ভব হয়েছে, নতুন ধারার রাজনীতির মাইলফলক হয়ে উঠেছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব, নব্বইয়ের অভ্যুত্থান, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান — এই প্রতিটি কালজয়ী অধ্যায়কে ধারণ করে, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জনগনের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতায়, তারেক রহমানের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে একজন ভিশনারি স্টেটস ম্যানের দেশপ্রেম ও নেতৃত্বের দৃঢ় প্রত্যয়। নেই কোন অভিযোগ, নেই কোন প্রতিশোধের শপথ, নেই কোন ব্যক্তি বিশেষের বন্দনা। এক বুক আশা নিয়ে দেড় যুগের নির্বাসনের জীবন কাটিয়ে তারেক রহমান এলেন, দেখলেন, জয় করে নিলেন ১৮ কোটি মানুষের হৃদয়। একজন সফল রাজনীতিক কেবল ইতিহাসের ব্যাখ্যাতা নন—তিনি নতুন ইতিহাসের স্রষ্টা। তারেক রহমান সেই ইতিহাস রচনায় নিজের নাম উজ্জ্বলভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রিয় নেতাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও অভিবাদন। নতুন যাত্রাপথ হোক সাফল্য, সাহস ও অর্জনে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
লেখক: বি.এস.সি ইন ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং,
এল.এল.বি, সাবেক সহ দপ্তর সম্পাদক
চট্টগ্রাম মহানগর যুবদল।
মোবাইল: ০১৮১৯৬১৭৩৮০
E-mail: [email protected]