মানুষের শরীরে প্রতিনিয়ত বিষ ঢুকছে। মাটি ও পানি থেকে মাছ, মাংস, সবজি এবং ফলমূল হয়ে মানবদেহে প্রবেশ করছে ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা ও আর্সেনিকের মতো ধাতু। ফলে, দিন দিন দেশে বিষাক্ত খাবার খেয়ে মানুষের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের লইট্টা শুঁটকিতে পাওয়া গেছে ক্ষতিকারক ‘ই কোলাই’ ব্যাকটেরিয়া।
চট্টগ্রামের চাক্তাই, রেয়াজউদ্দিন বাজার ও কর্ণফুলীর শুটকি মাছের ব্যবসায়িরা বলেছেন, তাঁরা জানেনা ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া কী? বেশির ভাগ ব্যবসায়িরা কক্সবাজার থেকে শুঁটকি সংগ্রহ করেন মণ হিসেবে। পরে চট্টগ্রাম তা এনে বাছাই করে গ্রেট তৈরি করেন।
যারা কাঁচা মাছ প্রসেস করে শুকায় তারা শুনেছেন। তবে তাতে কি কি মেডিসিন ব্যবহার করেন সে বিষয়ে ব্যবসায়িরা অবগত নন বলে জানান। কিন্তু মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকারক বিষ ব্যবহার করা হয় শুটকিতে যাতে পচন না ধরে। কোন পোকামাকড় যেন শুটকিতে বসতি করতে না পারে।
এমন অবস্থায় চলতি বছরের এপ্রিলে চালানো ঢাকা, চট্টগ্রাম শহরের ওপর চালানো এক গবেষণা সমীক্ষায় মাছ ও মুরগিতে ৮০ থেকে ৮৬ শতাংশ বিভিন্ন মাত্রায় ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম ও সিসার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। পরীক্ষায় ধাতু তিনটির মাত্রা শহরে বেশি এবং গ্রামে কম পাওয়া যায়।
অনেককাল থেকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত ব্যাটারিসহ অন্যান্য ভারী ধাতুর তৈরি বর্জ্য এখানে-সেখানে ফেলার কারণে মাটি, পানি এবং বাতাস দূষিত হয়ে পড়ে। এসব উৎস থেকে ধাতুগুলো সরাসরি এবং গবাদি পশু, ফল, ফসলের মাধ্যমে খাদ্য হয়ে মানবদেহে সহজেই প্রবেশ করে।
এর আগের এক গবেষণায় ধান ও ধানের ভুষিতে একই ধরনের ধাতুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব ভারী ধাতু থেকে দেশের পানিও মুক্ত নয়। এ ছাড়া মুরগি, ডিম ও চাউলে অর্সেনিক নামের প্রাণঘাতী বিষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এসব বিপজ্জনক বিষ খাদ্যের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মানবদেহে প্রবেশ করছে। দেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে মরণব্যাধি ক্যানসারসহ কিডনি রোগ ও স্নায়ুবিক জটিলতায়।
এছাড়া এর আগের এক গবেষণায় খাদ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ভয়াবহ দূষণ সমগ্র বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। বেশ কিছুকাল আগে থেকেই বলা হচ্ছে, অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিকের বর্জ্য প্রতিনিয়ত সিউয়েজের মধ্যে নদ-নদী, জলাভূমিতে গিয়ে পড়ছে। মাছ সেসব খাচ্ছে, আর মাছের মাধ্যমে তা মানুষের ফুড-চেইনে ঢুকে পড়ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের এক গবেষণা বলেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন বাজারে পাওয়া ১৫ প্রজাতির দেশি মাছে ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণার সন্ধান মিলেছে। এসব মাছ হচ্ছে- কালাবাউশ, বেলে, ট্যাংরা, কই, রুই, বাটা, পাবদা, পুঁটি, রয়না, শিলং, বাইন, টাটকিনি, বাছা, তেলাপিয়া ও কমন কার্পজাতীয় মাছ। এর মধ্যে আবার রায়না, টাটকিনি ও ট্যাংরা মাছের শরীরে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি রয়েছে। ভেজালের দৌরাত্ম্যে আজ অসহায় গোটা দেশ। বাজারের তৈরি খাদ্য থেকে শুরু করে খাবার তৈরির অনেক কাঁচামালই বিশুদ্ধ নয়।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর মধ্যে মারা যায় প্রায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া দূষিত খাবারজনিত কারণে ৫ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত হওয়া ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু।
সম্প্রতি দেশের নামিদামি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, দেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে ভুগছে। খাবার রান্নার জন্য ব্যবহার করা হয় পুরোনো নিম্নমানের তেল। নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবন কিডনি রোগ বাড়িয়ে তুলছে। শস্য ও সবজিতে কীটনাশক ও প্রিজারভেটিভের ব্যবহারের কারণে খাদ্যে হেভি মেটাল অ্যালমিয়া, অ্যাডমিয়া বা আর্সেনিকের প্রবেশ ঘটছে।
অনেক দিন এসব বিষাক্ত দ্রব্যমিশ্রিত খাদ্যগ্রহণের ফলে ক্রনিক কিডনি রোগ দেখা দিচ্ছে। ‘বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা জোরদারকরণে কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা প্রকল্প’বিষয়ক নেদারল্যান্ডস সরকারের অর্থায়নে আয়োজিত এক কর্মশালায় পাঁচটি পৃথক গবেষণায় দেশের উত্তরাঞ্চলের চাল, বাদাম, ভুট্টার ৬০টি নমুনার মধ্যে ৯টিতে যকৃৎ ক্যানসারের জন্য দায়ী অ্যাফ্লাটক্সিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়।
এসবের চারটিতে ছিল নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, আদর্শমাত্রার বেশি অ্যাফ্লাটক্সিন থাকলে তা হতে পারে ক্যানসার ও কিডনি রোগের কারণ। ২০২১ সালজুড়ে পরিচালিত এ গবেষণায় বাদাম ও ভুট্টাতে বিষাক্ত পদার্থের বেশি উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ময়মনসিংহের কিছু এলাকার গরুর দুধে সামান্য পরিমাণে অ্যামোক্সিসিলিন নামক অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধান মিলেছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের লইট্টা শুঁটকিতে পাওয়া গেছে ক্ষতিকারক ‘ই কোলাই’ ব্যাকটেরিয়া।
গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনায় ১৯ দশমিক ২ শতাংশ শসা, ১০ শতাংশ টমেটো ও ৩ দশমিক ৪ শতাংশ গাজরে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। দুগ্ধজাত পণ্যের মধ্যে ৭ দশমিক ১ শতাংশ, আইসক্রিম এবং ৪ শতাংশ দইয়ে লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজেনিস ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান মেলে।
বিশুদ্ধ খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম প্রধান। খাদ্যগ্রহণ ছাড়া মানুষসহ কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না। তবে সে খাবার অবশ্যই হতে হয় বিশুদ্ধ। দূষিত বা ভেজালমিশ্রিত খাদ্য মানুষের জন্য স্বাস্থ্যহানিকর। জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য পানিও আজ বিশুদ্ধ নয়। বোতলজাত পানির প্রায় ৫০ শতাংশ দূষিত। অফিস-আদালতে, বাসাবাড়িতে সরবরাহকৃত বড় বড় জারের পানির ৯৮ শতাংশই জীবাণুপূর্ণ।
বাজারের ৮৫ শতাংশ মাছে ফরমালিন মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। শুকিয়ে যাওয়া শাক রাসায়নিক পদার্থে ডুবিয়ে তাজা দেখিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া পুরোনো কাঁচামরিচে সবুজ রং মিলিয়ে বাজারে আনা হচ্ছে। ফলমূল দ্রুত পাকিয়ে রঙিন বানাতে সর্বত্রই কার্বাইড, ইথোফেন, আর ফরমালিন প্রয়োগ করা হচ্ছে। আটায় মেশানো হচ্ছে চক পাউডার বা ক্যালসিয়াম কার্বনেট।
পোলট্রি ফার্মের ডিমে ট্যানারি বর্জ্যস্থিত বিষাক্ত ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। আটায় মেশানো হচ্ছে চক পাউডার বা ক্যালসিয়াম কার্বনেট। আনারসে হরমোন প্রয়োগ করে দ্রুত বৃদ্ধিও প্রক্রিয়া চলে আসছে বহুদিন ধরে। আমগাছে মুকুল ধরা থেকে শুরু করে আম পাকা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে রাসায়নিক ব্যবহার এখন ওপেনসিক্রেট। মিষ্টিজাতীয় খাবারে ব্যবহার করা হয় বিষাক্ত রং, সোডা, সেকারিন ও মোম। মসলায় কাপড়ের বিষাক্ত রং, ইট ও কাঠের গুঁড়ো মেশানো হয়। নকল ও ভেজাল ওষুধে ছেয়ে গেছে বাজার।
ইতোপূর্বে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক পরীক্ষায় কোনো কোনো পণ্যে ৬৬ থেকে ৪৩ শতাংশ, কখনো ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ ভেজাল পাওয়া গেছে। নিত্যপণ্য চালেও ভেজাল মিলেছে ৯ শতাংশ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক প্রকারের পণ্যের ১ হাজার ৫৮টি নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা করে ভেজালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
এসব পণ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ ভেজাল পাওয়া যায় ঘিতে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এরপরই গুড়ে রয়েছে ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মধুতে রয়েছে ৩৩ দশমিক ৩৩ ভাগ ভেজাল। শিশুখাদ্য গুঁড়ো দুধে রয়েছে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ ভেজাল। এসব খাদ্যে রয়েছে ২৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ ভেজাল।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ভেজাল খাদ্যগ্রহণের ফলে প্রতিবছর দেশে তিন লাখ লোক ক্যানসার নামক মরণব্যাধিতে, দুই লাখ লোক কিডনি রোগে এবং দেড় লাখ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ ১৫ লাখ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মদান করেন।
চট্টগ্রাম সেভরন হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাহরিয়ার রুবেল জানান, ভেজাল খাদ্যগ্রহণের ফলে দেশে হেপাটাইটিস, কিডনি, লিভার ও ফুসফুস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। অনেকের দাঁতের সর্বনাশ হচ্ছে। সবার উচিত বিষ মাখানো শুটকি বর্জন করা। ফরমালিন যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা। বিদেশী ফলমূল না খেয়ে দেশী ফল খাওয়া। সবুজ শাকসবজি খাওয়া। খালি জায়গায় নিজেদের বাগান করা।
১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া ও ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে সেই আইনে।
চট্টগ্রামের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী জানান, ২০১৫ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। খাদ্যপণ্যে ভেজাল প্রতিরোধের মূল দায়িত্ব বিএসটিআইয়ের। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, র্যাব, পুলিশসহ ৬টি মন্ত্রণালয়ের দশটি বিভাগ ভেজাল বন্ধের দায়িত্বে নিয়োজিত। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার স্বাস্থ্য বিভাগেরও এ ব্যাপারে ভূমিকা রয়েছে।
খাদ্যকে বিষমুক্ত রাখতে ‘ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ বিল-২০১৫’- এই ফরমালিনের ব্যবহার রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ২০ লাখ ও সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান হয়েছে। এ আইনে ফরমালিন বিক্রির দোকান সাময়িকভাবে বন্ধসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়া ফরমালিন উৎপাদন, আমদানি, মজুদ, বিক্রয়, পরিবহন এমনকি ব্যবহার বা দখলে না রাখার নির্দেশনা দেওয়া আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য সবার আগে খাদ্যচক্রকে নিরাপদ রাখতে হবে। আর এজন্য মাটি পানি এবং বাতাসের দূষণ বন্ধ করতে হবে। খাদ্যপণ্যে বিভিন্ন বিষাক্ত ধাতব পদার্থের উপস্থিতির সহনীয় বা গ্রহণযোগ্য মানমাত্রা নির্ধারণ করে তা প্রচার চালাতে হবে, যাতে কোনো খাদ্যে ধাতুর উপস্থিতি শুনেই মানুষ নির্দিষ্ট খাবার খেতে দ্বিধা বোধ না হরে। বাজারে প্রাপ্ত খাদ্যপণ্যে ধাতুর উপস্থিতি পরীক্ষার জন্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।